চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি। উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়ের কিনার ঘেষে ছুটে গেছে আকাবাঁকা মেঠোপথ। কোন যান্ত্রিক দূষণ নেই। কোথাও আবার ধাবমান পথে ছুটে চলছে রূপালী ঝর্ণাধারা। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের সম্মিলন যেন এখানে। এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান। সিলেটের চা বাগানের খ্যাতি রয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। দেশের মোট চায়ের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। এজন্য সিলেটকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশও বলা হয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালোলাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান। তাই ছুটির অবসরে কিংবা বৈকালিক বিনোদনের তৃষ্ণা মেটাতে তারা ছুটে যান চা বাগানের সবুজ অরণ্যে। সারাটা বিকাল চলে সবুজের ভেতর লুকোচুরি, হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে অবগাহন। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে। আর বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চা বাগান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চা বাগান হলো- মালনীছড়া চা বাগান, লাক্কাতুরা চা বাগান, তারাপুর চা বাগান, দলদলি চা বাগান, খাদিম চা বাগান, বড়জান চা বাগান, গুল্নি চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, হাবিব নগর চা বাগান, আহমদ টি এস্টেট, খান চা বাগান, লালাখাল টি এস্টেট, শ্রীপুর চা বাগান, মুলাগুল চা বাগান ইত্যাদি। উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন চা বাগান : সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান। যার নাম ‘মালনীছড়া চা বাগান।’ ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে ১৮৪৯ সালে ১৫০০ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়া। বাগানটি বর্তমানে পরিচলিত হচ্ছে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে। ভ্রমনবিলাসী মানুষের কাছে আনন্দ ভ্রমন কিংবা উচ্ছ্বল সময় কাটানোর প্রথম পছন্দের স্থান হলো মালনীছড়া চা বাগান। সিলেট শহরের একেবারেই অদূরে হওয়ায় চা বাগান দেখতে পর্যটকরা প্রথমেই ছুটে যান মালনীছড়ায়। মালনীছড়া চা বাগানের প্রবেশদ্বার বেশ কয়েকটি। আপনি চাইলে যে কোন একটি পথ দিয়েই চা বাগান দর্শনের কাজ শুরু করতে পারেন। তবে ঝামেলা এড়াতে বাগানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়াই বাঞ্চনীয়। তারপর ঘুরে দেখেন বাগানের এপাশ থেকে ওপাশ। দেখে আসতে পারেন বাগানের বাংলো। মালনীছড়ার পাশেই রয়েছে আলী বাহার চা বাগান। ঘুরে আসতে পারেন ওখান থেকেও। লাক্কাতুরা চা বাগান : মালনীছড়া আর লাক্কাতুরা চা বাগান পাওয়া যাবে একই যাত্রা পথে। ব্যবধান শুধু রাস্তার এপাশ ওপাশ। শ্রেষ্টত্বের দিক থেকে লাক্কাতুরা চা বাগানটি কখনো কখনো মালনীছড়া চা বাগানকে ছাড়িয়ে গেছে। নগরীর চৌকিদেখি আবাসিক এলাকা পেরুনোর পর গলফ ক্লাবের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই একবারেই চলে যাবেন বাগানের মধ্যিখানে। বাগানের এপাশ ওপাশ ঘুরে গল্ফ ক্লাবের সুন্দরম টিলার উপরও হতে পারে আপনার আনন্দ আয়োজন। গল্ফ ক্লাব মাঠ পেরিয়ে আরো একটু সামনে এগুলেই পেয়ে যাবেন সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম। চারপাশে চা বাগান আর মাঝখানে স্টেডিয়াম, সত্যিই অসাধারণ! এমন সবুজ প্রকৃতির ভেতর স্টেডিয়াম পৃথিবীতে সম্ভবত একটাই। আরো বছর খানেক পর এখানেই বসবে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের জমকালো আসর। তারাপুর চা বাগান : তারাপুর চা বাগানও সিলেট শহরের একেবারেই অদূরে। নগরীর আম্বরখানা থেকে মদিনা মার্কেট যাওয়ার পথে পাঠানটুলা এলাকায় প্রকৃতির ছায়াঘেরা পরিবেশে তারাপুর চা বাগান। একবারেই লাগোয়াভাবে জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় মদন মোহন কলেজের ব্যবসায় শাখার ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারাপুর চা বাগান পর্যটকদের মাঝে আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় সবসময়ই পর্যটকদের পদচারনায় মূখর থাকে এ বাগানটি। দলদলি চা বাগান : নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকা থেকে এমসি কলেজের দিকে একটু অগ্রসর হলেই হাতের বাম পাশে উপজেলা খেলার মাঠ। এর পাশ দিয়েই ভেতরে যাওয়া রাস্তায় সামান্য গেলেই পেয়ে যাচ্ছেন দলদলি চা বাগান। মূল বাগানে যেতে হলে পার হতে হবে বেশ কিছু লোকালয়। লোকালয় থেকে ভেতরে যেতে হয় বিশাল বিশাল টিলা বেষ্টিত মেঠো পথ ধরে। তারপর মূল চা বাগান। ভেতরে যাওয়ার রাস্তাটি গাড়ীর জন্য বেশ সুবিধাজনক নয়, সে জন্য মোটর বাইক কিংবা নিজে পা হতে পারে আপনার সুবিধাজনক বাহন। একের ভেতর তিন : শহরতলীর শাহপরাণ মাজার গেট থেকে তামাবিল রোডে সামান্য গেলেই হাতের বাম পাশ দিয়ে ভেতরে গেছে খাদিম জাতীয় উদ্যানের রাস্তা। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে ভেতরে উদ্যান (খাদিম রেইন ফরেস্ট)। কিন্তু চা বাগানের জন্য এতোদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তামাবিল রোড থেকে একটু ভেতরে গেলেই একে একে পাওয়া যাবে বড়জান চা বাগান, গুলনি চা বাগান এবং খাদিম চা বাগান। বাগানের লাগোয়া পথে যেতে যেতে দেখা সবুজ দৃশ্যপট, শিল্পিত লোকালয় পর্যটকদের নজর কাড়ে সহজেই। রাস্তার পাশেই চা প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি হওয়ায় নাকে লাগে সতেজ চায়ের মধুমাখা ঘ্রাণ। এছাড়া হাবিব নগর চা বাগান, আহমদ টি এস্টেট এবং খান চা বাগানের অবস্থান সিলেট-তামাবিল সড়কের হরিপুর এলাকায়। লালাখাল টি এস্টেট : সিলেট-তামাবিল সড়কের সারিঘাট এলাকায় গিয়ে নৌকা করে যেতে হয় লালাখাল টি স্টেট। ঘন্টা খানেকের পথ। চা বাগানের সকল সৌন্দর্য ছাড়িয়ে গেছে সবুজ জলের আস্তরনে ছেয়ে যাওয়া নদীপথ। আসলেই অসাধারণ...! দু’পাশের সবুজ প্রকৃতির ছায়া যেন আছড়ে পড়েছে স্রোতস্বীনির বুকে। শ্রীপুর চা বাগান : জাফলং...! সবুজের সাথে সবুজের কি অপরূপ মেলবন্ধন! পর্যটন স্পট জাফলংয়ের কথা কে না জানে? প্রকৃতিপ্রেমীদের পদচারনায় প্রতিনিয়ত মূখর থাকে পর্যটন স্পট জাফলং। জাফলংয়ের সৌন্দর্যের মাঝে অন্য এক ভালোলাগার আবেশ সৃষ্টি করেছে শ্রীপুর চা বাগান। আপনার আগামীর জন্য এখানেও ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারেন কিছুটা সময়। সিলেট, যেন সবুজ প্রকৃতির অভয়াশ্রম! আর সবসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষের জন্য সেরা সময় এখনই। যখন প্রকৃতির সব বিচিত্র সৌন্দর্য মিশে আছে চা গাছের সবুজ পাতায়। তো এই অপরূপ চায়ের দেশে আপনি চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন । নি:সন্দেহে আপনার ভালো লাগেবে । সিলেটের পর্যটনের বিচিত্রতা : সিলেট পর্যটনে অপার সম্ভাবনারই এক প্রতিশব্দ। যুগে যুগে এই জনপদের রূপ-লাবণ্যের টানে ছুটে এসেছেন পর্যটকেরা। বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা, রূপ পিয়াসী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে নেই সে তালিকায়। সিলেটের রূপে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ জনপদের নাম দিয়েছিলেন ‘শ্রীভূমি’। বৈচিত্র আর সৌন্দর্যের কারণে সিলেটের পর্যটন ক্ষেত্রগুলোর আকর্ষণ কখনওই ফুরোবার নয়। রূপের খনি : প্রকৃতি যেনো সিলেটকে নিজের মতো করে সাজিয়েছে। সৌন্দর্যের সবকিছু যেন এখানটাতে উপুড় করে দিয়েছে প্রকৃতি। অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে এই অঞ্চলের রূপ-লাবণ্য। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো একধাপ বর্ণিল করেছে উত্তরে ভারতের প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পর্বতমালা। সিলেটে বেড়াতে এসে পর্যটকরা সীমান্তের ওপারের বাড়তি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন খুব সহজেই। প্রকৃতিকন্যা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জাফলং বেড়াতে এসে পর্যটকরা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান খাদিম রেইন ফরেস্ট, পান্না সবুজ জলের লালাখাল, দেশের প্রথম সমতল চা বাগান, তামাবিলস্থ গ্রিনপার্ক এবং পাহাড়, নদী ও জলধারার অপূর্ব মিশেল পাংথুমাইয়ে। আর বাড়তি পাওনা-বর্তমানে দেশের পর্যটনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রাতারগুল। এশিয়ার ২৬টি জলাবনের অন্যতম গোয়াইনঘাটের রাতারগুল না দেখলে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ অসম্পূর্ণ থেকে যাবারই কথা। উত্তরে সিলেট নগরীর সীমানা পেরুলেই দেখা যাবে থরে থরে সাজানো চা বাগান। লাক্কাতুরা, মালনিছড়া আর তারাপুর চা বাগানে নারী শ্রমিকদের চা চয়নের দৃশ্যে স্থির হয়ে যায় পর্যটকের চোখ। সিলেটজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোও আলাদা দেশের অন্য এলাকা থেকে। কোনটা স্বচ্ছ জল, কোনটা সীমান্তরেখা বরাবর বয়ে চলা অথবা কোনটা পাথর কোয়ারির জন্য পর্যটকদের চোখ আটকে রাখে। আর সমুদ্রসম হাকালুকি হাওরের মায়া কাটানো কি সম্ভব। সিলেটের মতো টিলা, পাহাড়, ঘনসবুজ বন আর চা বাগানে সাজানো না হলেও সুনামগঞ্জে প্রকৃতি তার উদারতা মেলে ধরেছে বিশাল জলরাশির মাঝে। তাইতো টাঙ্গুয়ার হাওর ইতোমধ্যে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘মিনি সমূদ্র’ হিসেবে। আর তাহিরপুরের যাদুকাটা বা বারেক টিলার সৌন্দর্যের টানে পর্যটকরা দূর্গম পথে পা বাড়াতেও দ্বিধা করেন না। সিলেটের ঐতিহ্য চা আর কমলা বাগানের প্রকৃত রূপ দেখতে হলে যেতে হবে মৌলভীবাজারে। শ্রীমঙ্গলের চা বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ড, পরিকুন্ড, হামহাম মৌলভীবাজারের পর্যটনকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। আর এর সবটুকুই কেবল প্রকৃতির কল্যাণে। সিলেট বেড়াতে এসে মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে না পারলে অতৃপ্ত থেকে যান পর্যটকরা। আর হবিগঞ্জে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান- সে প্রকৃতির আরেক উদারতা, বিচিত্রতা। ঐতিহ্যের পরশ : সিলেটর গায়ে গায়ে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের বাক বদলের নানা গল্প। সিলেটজুড়ে ইতিহাসের নানা নিদর্শন এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সিলেটের মধ্যখানে শুয়ে আছেন সিলেট বিজয়ী বীর সাধক হযরত শাহজালাল (রাহ.)। পথে পথে ছড়িয়ে আছে তার সিলেট বিজয়ের স্মারক। সিলেটের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে খুঁজে মিলবে না শাহজালালের সফরসঙ্গীর সমাধি। শাহজালালের কাছে পরাজিত গৌড়ের রাজা গৌবিন্দের রাজ প্রাসাদের চিহ্ন এখনও টিকে আছে নগরীতে। আছে তার পালিয়ে যাওয়ার পথের চিহ্নও। জৈন্তার প্রতাপশালী নারী রাজ্যের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জৈন্তা রাজবাড়ি। এখানে টিকে থাকা মেগালিথিক পাথরের নিদর্শন আজও জানান দিচ্ছে সিলেটের প্রাচীনত্বের। জৈন্তার প্রাচীনত্বের প্রমাণ রয়েছে মহাভারতেও। বাক বদলের ইতিহাসেও সিলেটের গৌরবোজ্জ্বল অংশীদারিত্ব রয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে সিলেটের গৌরবময় সক্রিয় অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতির অংশ হয়ে আছে হবিগঞ্জের মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগান। এখানেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিকপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া নগরীর বুকে টিকে থাকা রায়নগর ও মীর্জাজাঙ্গাল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং সুনামগঞ্জের গৌরারং জমিদার বাড়ি-এ অঞ্চলের সভ্যতা, জন ও জনপদের ইতিহাস বহন করে চলছে। এসব প্রত্মতাত্ত্বিক নির্দশন গবেষকদের চোখেই আকর্ষণীয় নয় নয় সাধারণ পর্যটককেও টেনে নিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। যারা অন্তর্চক্ষু দিয়ে ইতিহাসের পাতা ঘাঁটেন সেসব পর্যটকরা এসব স্থানে এসে সভ্যতার সৌন্দর্য খুঁজে ফিরেন। সিলেট এক পূন্যভূমি : হযরত শাহজালালের (রাহ.) চরণস্পর্শে পূন্যভূমির তকমা পাওয়া সিলেট তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছেও সিলেট তীর্থসম। ভগবান শ্রী চৈতন্যের আদি পুরুষের ভিটা এই সিলেটেই। তার পিতা জগন্নাথের জন্ম সিলেটেই। শ্রী চৈতন্য তথা নদীয়ার নিমাই’র গাঢে মায়ের গর্ভে থাকতেই লেগেছিলো সিলেটের হাওয়া। ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই সিলেট বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থে হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ৫১টি পীঠস্থানের দুইটির অবস্থান সিলেটে। এর মধ্যে একটি সিলেট সদর উপজেলার কালাগুলে অপরটি জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরে। এছাড়া সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের পণাতীর্থের বিশেষ কদর রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এখানকার জাদুকাটা নদীতে বিশেষ সময়ে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের পূন্য মেলে। তাই বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পণাতীর্থে দেশ বিদেশের পূন্যার্থীদের ভিড় জমে। এ সকল তীর্থের বাইরে সিলেটে রয়েছে বৌদ্ধবিহার, ঐতিহ্যবাহী প্রেসবিটারিয়ান চার্চ। এসব তীর্থস্থানে প্রতিদিনই হাজার হাজার পর্যটকদের আগমন ঘটে। বিশেষ ধর্মীয় উৎসবে এর মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। নামকরনের তথ্য : সিলেটের নামকরণের সাথেও মুসলিম এবং সনাতন ধর্মালম্বীদের আবেগ জড়িয়ে আছে। সিলেটের নামকরণ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কিংবদন্তিমতে, হযরত শাহজালালের (রাহ.) সিলেট বিজয়ের সময় তাকে রুখতে গৌড়ের রাজা গোবিন্দ পথে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। শাহজালালের বিজয়যাত্রাকে থমকে দিতে রাজ্যের প্রবেশমুখ বিশাল পাথর দিয়ে আটকে রাখেন রাজা গোবিন্দ। কিন্তু সে পাথরখ-ও শাহজালালের পথ আটকে রাখতে পারেনি। তিনি পাথরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শিল (পাথর) হট (সরে যাও)। তার নির্দেশে পাথরখ-টি সরে গিয়ে পথ করে দেয়। অনেকের মতে শিল-হট শব্দ যুগল থেকেই সিলেট নামের উৎপত্তি। আবার পুরাণমতে, সতী বা পার্বতী দেহত্যাগ করলে তার দেহের বিভিন্ন অংশ উপমহাদেশের একান্নটি স্থানে পতিত হয়। এর মধ্যে দু’টি হাড় (হড্ড) সিলেটেও পতিত হয়। সতীর অপর নাম শ্রী, তার হাড় মানে শ্রীহড্ড। শ্রীহড্ড থেকেই শ্রীহট্ট নামের উৎপত্তি বলে অনেকের অভিমত। সিলেট নামকরণ প্রসঙ্গে অন্য একটি বর্ণনা হচ্ছে, প্রাচীন গৌড়ের রাজা গুহক তার কন্যা শীলাদেবীর নামে একটি হাট স্থাপন করেন। সেই শীলা হাটই কালের পরিক্রমায় সিলেটে পরিণত হয়। নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী : নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময় জীবনধারা সিলেটের পর্যটন ক্ষেত্রকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সিলেটে বসবাসকারী মণিপুরী, খাসিয়া, লালেং বা পাত্র, চা শ্রমিক, ওরাঁও সম্প্রদায়ের জীবন বৈচিত্র্য বর্ণিল করেছে এখানকার পর্যটনকে। মণিপুরীদের তাঁতশিল্প, মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায় ও চা শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা পর্যটকদের মূগ্ধ করে। ওরাঁও, লালেং ও চা শ্রমিকদের মাটির তৈরি আর খাসিয়াদের মাচার উপর তৈরি ঘর দেখে পর্যটকরা বিমোহিত হন। খাসিয়া ও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পরিধেয় পোশাকও ভিন্ন। মণিপুরী সে পোশাকের চাহিদা রয়েছে বাঙালি ললনাদের মাঝেও। সে চাহিদা কেবল সিলেটের সীমানাতেই আটকে থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ছবি : সিলেট মানেই যেনো মন পাগল করা লোকগানের সুর। সিলেটের হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে আছে মাটির কথা, মাটির সুর। বাংলা তথা ভারতীয় গণসঙ্গীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই সিলেটেরই সন্তান। শতবর্ষ আগে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের মিরাশির গ্রামে জন্ম নেন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের এ সংগ্রামী যোদ্ধা। লোকগানের সম্রাট হাছন রাজা সিলেটেরই আরেক পরিচয়। সুনামগঞ্জ ও সিলেটে অবস্থিত হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো পর্যটকদের আলাদাভাবে টানে। সিলেটের ভাটি অঞ্চলে জন্ম নেওয়া বাউল সম্রাট আবদুল করিমের গান তো এখন লোকের মুখে মুখে ফিরে। আবদুল করিমের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজান ধল গ্রামে অনুষ্ঠিত করিম মেলা প্রতি বছর বাউল ও বাউলপ্রেমীদের উৎসবে পরিণত হয়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরাও এ মেলায় অংশ নেন। সিলেটের সন্তান বাউল সাধক রাধা রমন, দুর্বিন শাহ, আরকুম শাহ, শীতালং শাহ’র স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোরও রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। রুচির বিকাশে হারিয়ে যাওয়া গাটু বা ঘেটু গানের জন্মও এই সিলেটেই। এই গাটু বা ঘেটু গান নিয়ে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন জনপ্রিয় নির্মাতা কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। সদ্যপ্রয়াত এ চলচ্চিত্র নির্মাতার শেষ ছবিও এটি। কেবল গান নয় নৃত্য শিল্পেও সিলেটের গৌরবগাঁথার কমতি নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সিলেট এসেছিলেন মাছিমপুরে মণিপুরী নৃত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সিলেট থেকেই মণিপুরী নৃত্য বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শান্তি নিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষাদানের জন্য সিলেট থেকেই শিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সিলেটের অবদানও অনেক সুপ্রাচীন। ঐতিহাসিকরা প্রমাণ পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও সিলেট এবং সিলেটীদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। চর্যাপদে সিলেটের মানুষের কথ্য ভাষার মিল থাকাটা এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। গবেষকদের মতে, চর্যার অনেক পদকর্তাই সিলেটের অধিবাসী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ময়মনসিংহ গীতিকা‘র অধিকাংশ কাহিনীও সিলেট অঞ্চলের বলে ঐতিহাসিকদের দাবি। গীতিকায় বর্ণিত স্থানগুলোর অস্তিত্বও সিলেটেই খুঁজে মেলে। তাদের মতে, ময়মনসিংহ গীতিকা আদতে ‘সিলেট গীতিকা’ কিংবা ‘জালালাবাদ গীতিকা’। নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আগলে রাখার জন্য সিলেটের নিজস্ব লিপিও রয়েছে। নাগরি নামে এ লিপিরও রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। বাংলা ভাষার বিকল্প লিপি সিলেটি নাগরীই হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র ভাষাহীন লিপি। শেষ কথা : অপার সম্ভাবনা সত্ত্বেও সিলেটে পর্যটন শিল্পের তেমন বিকাশ ঘটছে না। পর্যটন নগরী হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া, নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুর্বল অবকাঠামো ও উদ্যোগের অভাবে এখনো সেই অনুপাতে আসছেন না দেশী-বিদেশী পর্যটক। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেবল পরিকল্পনার অভাবে বিদেশী পর্যটক আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস